পৃষ্ঠাসমূহ

Sunday, February 19, 2012

হুমায়ূন আহমেদ

রহস্য

রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু প্রায়ই এ রকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়। গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, তার ঘরে একটি তক্ষক আছে – সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকে। আমি বহু কষ্টে হাসি থামালাম। এ রকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?
জ্বি না।
এক রাত থাকেন আমার বাসায়। নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটা। ঘড়ি ধরে বসে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে।
আরে দুর! কি যে বলেন?
ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেন। চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা। পৃথিবীটা এরকম, যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় না। ভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?
হ্যাঁ চিনি।
তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজের কানে শুনেছেন। বলেছেন একটা নিউজ করবেন।
ভালই তো। নিউজ হবার মতই খবর।
আপনি আসেন না ভাই, থাকেন এক রাত।
আমাকে শোনালে কি হবে?
আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচার। আপনাদের কথার একটা আলাদা দাম।
তাই নাকি?
আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না।
এই জিনিসটা নিয়ে খুব হৈ-চৈ করছেন মনে হচ্ছে?
না, হৈ-চৈ কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেন। বাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নাজমুল হুদাকে চেনেন?
জ্বি না।
উনিও এসেছিলেন। খুব মাইডিয়ার লোক। আপনি আসুন না।
আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে।
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি মুখভর্তি করে হাসলেন। টেনে-টেনে বললেন, চলেন চা খাই।
না, চা খাব না।
আরে ভাই আসেন না। প্রফেসর মানুষ, আপনাদের সঙ্গে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার।
ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেতে হল চায়ের দোকানে।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? চপ?
না।
আরে ভাই খান না। এই এদিকে দু’টো চা দে তো। এখন ভাই বলেন, কবে যাবেন?
আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলে দেব একদিন।
চা খেতে খেতে ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটা রহস্যের কথা শুরু করলেন। নাইনটিন সিক্সটিতে তিনি বরিশালের পিরোজপুরে থাকতেন। তার বাসার কাছে বড় একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। অমাবস্যার রাতে নাকি সেই কাঁঠাল গাছ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, সেই কান্নারও কি কোন টাইম ছিল? নির্দিষ্ট সময়ে কাঁদত? আপনার তক্ষকের মত?
ভদ্রলোক আহত স্বরে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
বিশ্বাস করব না কেন?
আমি কান্নার শব্দ গোটাটা টেপ করে রেখেছি। একদিন শোনাব আপনাকে।
ঠিক আছে।
বরিশালের ডিসি সাহেবও শুনেছেন। চেনেন উনাকে? আসগর সাহেব। সি এস পি। খুব খান্দানী ফ্যামিলি।
না, চিনি না।
ডিসি সাহেবের এক ভাই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিরাট অফিসার।
তাই বুঝি?
জ্বি। উনার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। খুব খাতির-যত্ন করলেন। গুলশানের বাসা। তিন তলা। উনি থাকেন এক তলায়। ওপরের দুটো তলা ভাড়া দিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমার প্রায় এক ঘন্টা সময় নষ্ট করে বিদায় হলেন। আমার মায়াই লাগলো। ইন্ডেন্টিং ফার্মে সামান্য একটা চাকরি করেন। দেখেই বুঝা যায় অভাবে পর্যুদস্ত। চোখের দুষ্টি ভরসাহারা। বয়স এখনো হয়তো ত্রিশ হয়নি কিন্তু বুড়োটে দেখায়। বিচিত্র চরিত্র।
মাস খানেক তার সঙ্গে আমার দেখা হল না। তার প্রধান কারণ, যে সব জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সে সব জায়গা আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করেছি। নিউমার্কেটে আড্ডার জায়গাটিতে যাই না। কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এই লোকটি পিচ্ছিল পদার্থ, সে গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাবে। আর ছাড়ানো যাবে না। কিন্তু তবু দেখা হল। একদিন শুনলাম সে ইউনিভার্সিটি ক্লাবে এসে খোঁজ নিচ্ছে। ক্লাবের বেয়ারা বলল, গত কিছুদিন ধরে নাকি সে নিয়মিতই আসছে। কি মুসিবত।
একদিন আর এড়ানো গেল না। ভদ্রলোক বাসায় এসে হাজির।
কি ভাই আপনি তো আর এলেন না?
কাজের ব্যস্ততা …
আজকে আপনাকে নিতে এসেছি।
সে কি?
কবি শামসুল আলম সাহেবও আসবেন।
তাই বুঝি?
জ্বি। চিনেত তো শামসুল আলম সাহেব কে? দু’টো কবিতার বই বেরিয়েছে। পাখির পালক আর অন্ধকার জ্যোত্স্না।
তাই বুঝি?
জ্বি। আমাকে দু’টো বই-ই দিয়েছেন। খুবই বন্ধু মানুষ। বাড়ি হচ্ছে আপনার ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা।
ও।
উনার ছোট ভাইও গল্প টল্প লেখেন। আরিফুল আলম।
গেলাম তার বাসায়। ঝিকাতলার এক গলিতে ঘুপসি মত দু’কামরার বাড়ি। মেজাজ খুবই খারাপ। রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে সময়নিষ্ঠ তক্ষকের ডাক শোনার জন্য। কত রকম যন্ত্রণা যে আছে পৃথিবীতে!
ভদ্রলোক আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। মহিলার হাতের সযত্ন স্পর্শ আছে। ভদ্রলোক বিবাহিত জানতাম না। এ নিয়ে তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন। খুবই অল্প বয়েসী তরুণী এবং অসম্ভব রূপসী। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম।
আমার স্ত্রী লীনা। আর লীনা, উনি হুমায়ূন আহমেদ। এর কথা তো তোমাকে বলেছি।
লীনা হাসি মুখে বললো, জ্বি আপনার কথা প্রায়ই বলে।
লীনা একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।
লীনা চলে গেল ভেতরে। ভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, লীনার গল্প-উপন্যাস লেখার শখ আছে। কয়েক দিন আগে সাপ নিয়ে একটা গল্প লিখেছে। মারাত্মক গল্প ভাই। আপনাকে পড়ে শোনাতে বলবো। আমি বললে পড়বে না। আপনিও কাইন্ডলি একটু বলবেন।
আমি বললাম, গুণী মহিলাতো!
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
তা ভাই, কথাটা অস্বীকার করব না। গানও জানে। নজরুল গীতি। ভালো গায়। বাড়িতে টিচার রেখে শিখেছে।
তাই নাকি?
জ্বি, শোনাবে আপনাকে। একটু প্রেসার দিতে হবে আর কি। আপনি একটু রিকোয়েস্ট করলেই শোনাবে। কাইন্ডলি একটু রিকোয়েস্ট করবেন।
ঠিক আছে, করব।
চা এসে পড়ল। চায়ের সঙ্গে বড়া জাতীয় জিনিস। বেশ খেতে। আমি বললাম, কিসের বড়া এগুলি? ডালের নাকি?
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হাসলেন, নারে ভাই, কুলের বড়া। হা-হা-হা। কত রকম অদ্ভুত রান্না যে জানে! মাঝে মাঝে এত সারপ্রাইজ হই। খেতে কেমন হয়েছে বলেন? চমত্কার না?
ভাল, বেশ ভাল।
আরেক দিন আসবেন, চাইনীজ সুপ খাওয়াবো। চিকেন কর্ন সুপ। চাইনীজ রেস্তোরাঁর চেয়ে যদি ভালো না হয় তাহলে কান কেটে ফেলবেন। হা-হা-হা।
আমি মেয়েটার লেখা একটা ছোট গল্প শুনলাম, দু’টি কবিতা শুনলাম। ভদ্রলোক মুগ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। বার বার বললেন, ইস শামসুল আলম সাহেব আসলেন না। দারুণ মিস্ করলেন, কি বলেন ভাই?
রাত এগারোটার দিকে বললাম, তা হলে আজ উঠি?
তক্ষকের ডাক শুনবেন না?
আরেক দিন শুনব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। ভুলবেন না যেন ভাই। আসতেই হবে।
ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন। রাস্তায় নেমেই বললেন, আমার স্ত্রীকে কেমন দেখলেন ভাই?
ভাল, গুণী মহিলা।
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ধরা গলায় বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা। ঠিক না ভাই?
আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, গরীব মানুষ, স্ত্রীর জন্যে কিছুই করতে পারি না। কিন্তু এই সব নিয়ে লীনা মোটেই মাথা ঘামায় না। বড় ফ্যামিলির মেয়ে তো। ওদের চাল চলনই অন্য রকম।
আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভাগ্যবান আপনি।
ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেন। যেন আবেগে কেঁদে ফেলবেন।
ভাই, আরেকদিন কিন্তু আসতে হবে। তক্ষকের ডাক শুনতে হবে। আসবেন তো? প্লীজ।
তক্ষকের ডাকের মত কত রহস্যময় ব্যাপারই না আছে পৃথিবীতে!

ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি৷ লেকচারার থেকে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হয়েছি৷ বেতন বাড়েনি, যন্ত্রণা বেড়েছে৷ আমাকে দূর-দূরান্তরে পরীক্ষা নিতে পাঠানো হচ্ছে৷ পটুয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর৷ কলেজগুলোতে পড়াশোনা হয় না বললেই চলে৷ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই৷ ছাত্ররা কিছুই পারে না৷ অতি সহজ প্রশ্নে মাথা চুলকায়, ঘাড় চুলকায়৷ মাথা এবং ঘাড় থেকে প্রশ্নের উত্তর আসে না৷
অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, পানির ফর্মূলা কী? সে আমতা আমতা করে বলে, H2O৷ যেন তার সন্দেহ আছে আসলেই H2O কিনা৷ তারপর জিজ্ঞেস করি, D2O কী? যারা কেমিস্ট্রি জানেন না তাদের বলছি, D2O হচ্ছে হেভি ওয়াটার৷ হাইড্রোজেন অ্যাটমে প্রটোন থাকে একটা, এখানে দুটা৷ D হলো হাইড্রোজেনের একটা Isotope৷ অতি সহজ এই প্রশ্নে পরীক্ষার্থী পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বলে, স্যার হচ্ছে D2O ঢাকার পানি৷ তাহলে রাজশাহীর পানির ফর্মূলাটা কী? স্যার R2O৷ বরিশালের পানি? স্যার B2O৷ বরগুনার পানি? এইবার ছাত্র উৎসাহী৷ সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে৷ সে হাসিমুখে জবাব দেয়, বরগুনার পানিরও স্যার একই ফর্মূলা B2O৷
আমি হতাশ চোখে পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ ইন্টারনাল একজামিনার হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, পাস করিয়ে দিতে হবে স্যার৷ গরিবের ছেলে৷ কষ্ট করে লেখাপড়া করছে৷ ভাবটা এ রকম যে, ধনীর ছেলেমেয়েদের কেমিস্ট্রি জেনে পাস করতে হবে৷ গরিবের ছেলের পাসটা প্রয়োজন৷ কেমিস্ট্রি জানা প্রয়োজন না৷
বাইরে পরীক্ষা নিতে গেলে ভাইভা বিষয়ক অতি ক্লান্তিকর অবস্থার ভেতর যেতে হয়৷ ছাত্রদের ফেল করাতে ইচ্ছা করে না, আবার পাস করাতেও ইচ্ছা করে না৷ ভাইভা নিতে কষ্ট৷ থাকা-খাওয়াতেও কষ্ট৷
এক্সটারনাল শিক্ষকদের থাকার জায়গা হয় সাধারণত ল্যাবরেটরির লাগোয়া ঘরে৷ উদাহরণ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ৷ সেখানে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ওই ঘরে অনেকদিন থেকেছি৷ একবার ভূতও দেখেছিলাম৷ যেসব কলেজে এ রকম কোনো ঘর নেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয় কোনো শিক্ষকের বাসায়৷ ভদ্রলোক হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন, সেখানে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো অচেনা অজানা একজন মানুষ থাকতে আসেন৷ যাকে আপন করে নেওয়া যায় না, আবার দূরেও ঢেলে রাখা যায় না৷
এক্সটারনাল ভদ্রলোক ইচ্ছা করলেই ভাইভায় প্রচুর ফেল করিয়ে ঝামেলা করতে পারেন৷ একবার কেমিস্ট্রির এক শিক্ষকের বাসায় আমার থাকার জায়গা হলো৷ ভদ্রলোকের বাসায় একটা বাথরুম৷ সেই বাথরুম স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে এটাচড৷ আমার আবার রাতে কয়েক দফা বাথরুমে যেতে হয়৷ ভদ্রলোক অবশ্য খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমার শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকবে৷ আপনার যতবার ইচ্ছা বাথরুমে যাবেন৷ কোনো সমস্যা নেই৷
দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম, এখন মূল গল্পে আসি৷ আমি পরীক্ষা নিতে গেছি পটুয়াখালীতে৷ ল্যাবরেটরির পাশের টিচার্স রুমে খাট পেতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ গরমকাল৷ বেশির ভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি নেই৷ ফ্যান চলে না৷
প্রথম রাতে একফোঁটা ঘুম হলো না৷ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি৷ রাত তিনটায় মশারির ভেতর থেকে বের হলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে শত শত মশা আমাকে ছেঁকে ধরল৷ আবার মশারির ভেতর ঢুকলাম৷ গরমে টিকতে না পেরে আবার বের হলাম৷ মশাদেরকে বললাম, তোমরা যারা এখানে আছ তারাই আমার রক্ত খাও, বাইরে থেকে কাউকে ডেকে এনো না৷ ঘরটাকে আমার মনে হলো হাজতখানা৷ এই হাজতে সাতটা রাত পার করতে হবে ভেবে খুবই দমে গেলাম৷ এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে? হঠাৎ করে মনে হলো একটা নদী কল্পনা করলে কেমন হয়?
নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে আমি বসে আছি৷ উথাল পাতাল হাওয়া নদীর উপর দিয়ে উড়ে আসছে৷ এমন হাওয়া যে আমার সামান্য শীত শীত ভাব হচ্ছে৷ আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মশক বানিহীকে সম্পূর্ণ অগ্রহ্য করে নদী কল্পনা শুরু করলাম৷ নদীর একটা সুন্দর নামও দিলাম – ময়ূরাক্ষী৷ যারা আমার লেখা পড়ছেন তারা হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার গরম লাগা কমে গেল৷ নদীর প্রবল হাওয়ায় মশারা উড়ে গেল৷ আমার খানিকটা শীত শীতও করতে লাগল৷
এভাবেই তৈরি হলো হিমু, যে যেকোনো অবস্থায় কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর কাছে চলে যেতে পারে৷ হিমুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাসটির নাম ময়ূরাক্ষী৷ ময়ূরাক্ষীর হিমু আমি নিজে৷ প্রথম লেখা হিমু বিষয়ক বইয়ে ময়ূরাক্ষী নদী কীভাবে চলে এল, একটু দেখা যাক৷
ছোটবেলার কথা৷ ক্লাস সিক্সে পড়ি৷ জিওগ্রাফি পড়ান মফিজ স্যার৷ তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার-টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে৷ স্যার মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল৷ আমাদের ধারণা ছাত্রদের গালে চড় বসাবার জন্য আল্লাহতালা স্পেশালভাবে স্যারের এই হাত তৈরি করে দিয়েছেন৷ স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল – রাম চড়, শ্যাম চড়, যদু চড়, মধু চড়৷
এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চড় হচ্ছর রাম চড়, সবচেয়ে নরমটা হচ্ছে মধু চড়৷ স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন – বাংলাদেশের নদ-নদী৷ ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বল তো৷ চট করে বল৷ মফিজ স্যার কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়৷ কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে৷ মনে হয় মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে৷
কী ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? নাম বল৷ আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আড়িয়াল খাঁ৷ স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন৷ খুব সম্ভব রাম চড়৷ হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এল আড়িয়াল খাঁ? সব সময় ফাজলামি? কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি কানে ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়৷
আরেকটি বড় খাবার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম৷ তিনি বিষন্ন গলায় বললেন, এখনো কানে ধরে আছিস কেন? হাত নামা৷ আমি হাত নামালাম৷ স্যার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তোকে শাস্তি দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে, খুবই অন্যায়৷ তোকে নদীর নাম বলতে বলেছি, তুই বলেছিস৷ আয় আরও কাছে আয়, তোকে আদর করে দেই৷
স্যার এমন ভঙ্গিতে মাথায় এবং পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে পানি এসে গেল৷ স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ৷ আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে৷ আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল৷ আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ূরাক্ষী৷
ময়ূরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি৷ কোথাকার নদী?
জানি না স্যার৷
এই নামে আসলেই কি কোনো নদী আছে?
জানি না স্যার৷
স্যার হালকা গলায় বললেন, আচ্ছা থাক৷ না থাকলে নেই৷ এটা হচ্ছে তোর নদী৷ যা জায়গায় গিয়ে বস৷ এমনিতেই তোকে শাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়েছে৷ তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মন খারাপটা বাড়াচ্ছিস৷ আর কাঁদিস না৷

নয় নম্বর বিপদ সংকেত

পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না ময়ূরাক্ষী বের হওয়ার পর পরই যুবক শ্রেণীর বিরাট অংশ হলুদ পাঞ্জাবী পরে রাস্তায় নেমে গেল৷ আমিও মনের আনন্দে একের পর এক হিমু বাজারে ছাড়তে লাগলাম৷ পাশ বইয়ের খাতায় টাকা জমা হতে লাগল৷ শুরুতে হিমুকে আমি মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিনি৷ তখন আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি৷ আমি লিখছি মিসির আলি৷ এই ভদ্রলোকের লজিকে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ৷
এর মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে৷ বন্ধু-বান্ধব, ব্যাংক এবং প্রকাশকদের কাছ থেকে ধার করে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি৷ পনেরশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট৷ তাতে কী, দুটো বেডরুম আছে৷ একটা বারান্দা আছে৷ বারান্দায় বসলে সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই না৷ জুতার দোকান দেখতে পাই৷ ছয়তলা থেকে জুতার দোকান দেখা খারাপ কিছু না৷
বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমি জুতার দোকান দেখি এবং পরের লেখাটা কী হবে ভাবি৷ আমার তিন মেয়ে তখন সামান্য বড় হয়েছে৷ বড় মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে, মেজোটি পড়ে ক্লাস ফোরে৷ ভোরবেলা স্কুলের পোশাক পরে তারা কিছুক্ষণ ধবল রঙের ডিপফ্রিজের সামনে দাঁড়ায়৷
কারণ তাদের বাবা রাতে যা লিখেছে তা ডিপফ্রিজের উপর সাজানো থাকে৷ আমার এই দুই কন্যা বাবার লেখার সর্বশেষ অংশ না পড়ে স্কুলে যাবে না৷ আমার লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে পড়ে না৷ আমার এই দুই কন্যার কোনো একজন, খুব সম্ভব বড়জন আমাকে একদিন বলল, বাবা ময়ূরাক্ষীর মতো আরেকটা বই লেখ৷ হিমুর বই৷
হিমুকে নিয়ে কন্যার আগ্রহে লিখে শেষ করলাম দরজার ওপাশে৷ বই প্রকাশিত হলো৷ আমি পড়লাম মহাবিপদে৷ হাইকোর্টে বিচারকদের সমিতি আছে৷ সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো, এই বইটি লিখে আমি মহা অন্যায় করেছি৷ মহান বিচারকদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছি৷ কারণ আমি লিখেছি জজ সাহেবরা ঘুষ খান৷
উপন্যাসে ঘটনাটা এ রকম – হিমুর মাতুল বংশ পিশাচ শ্রেণীর৷ তারা হেন দুষ্কর্ম নাই যা করে না৷ তাদের ধারণা যেকোনো কাজ টাকা দিয়ে করানো সম্ভব৷ তাদেরই একজন জজ সাহেবকে ঘুষ দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছে৷ জজ সাহেবরা ঘুষ খান – এটি হিমুর ধান্ধাবাজ মামার কথা৷ বইতে কিভাবে এসেছে দেখা যাক৷
মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন৷ দীর্ঘ সময় লাগল নামাজ শেষ করতে৷ তার চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মতো৷ ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি৷ মোনাজাত করার সময় টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল৷ আমি অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখলাম৷
তারপর বল, কী ব্যাপার?
একজন লোক জেলখানায় আছে মামা৷ ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার, দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না৷ দরখাস্ত করেছি, লাভ হয়নি৷
খুনের আসামি? তিনশ বারো ধারা?
কোন ধারা তা জানি না, তবে খুনের আসামি৷
এটা কোনো ব্যাপারই না৷ টাকা খাওয়াতে হবে৷ এই দেশে এমন কোনো জিনিস নেই যা টাকায় হয় না৷
টাকা তো মামা আমার নেই৷
টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি নাকি? আমরা আছি কী জন্য? মরে তো যাই নাই৷ টাকা সঙ্গে নিয়ে আসছি৷ দরকার হলে জমি বেঁচে দেব৷ খুনের মামলাটা কী রকম বল শুনি৷ আসামি ছাড়ায়ে আনতে হবে৷
তুমি পারবে না মামা৷ তোমার ক্ষমতার বাইরে৷
আগে বল, তারপর বুঝব পারব কী পারব না৷ টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না৷ এক লাখ টাকা থাকলে দুটো খুন করা যায়৷ প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার৷ পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে৷
আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম৷ মামা গালে হাত দিযে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনলেন৷ সব শুনে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশের সাজানো মামলা, পেছনে আছে বড় খুঁটি৷ কিছু করা যাবে না৷ ট্রাইব্যুনাল করলে কোনো আশা নাই, সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে৷ জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে৷ আগে জজ সাহেবরা টাকা খেত না৷ এখন খায়৷ অনেক জজ দেখেছি কাতলা মাছের মতো হাঁ করে থাকে৷ কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি৷
মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই৷ সব সময় শুনেছি মামলা লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্টে যায়, তারপর সুপ্রিম কোর্টে৷ আমার বেলায় সরাসরি হাইকোর্ট থেকে তলব৷ শুধু আমি একা আসামি তা কিন্তু না৷ আমাকে নিয়ে বিচারকরা মামলা করেছেন এই বিষয়টি যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তারাও আসামি৷ তাতে আমার সুবিধা হলো, পত্রিকার সম্পাদকরা বড় বড় ব্যারিস্টার দিলেন৷ এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন এবং ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নাম মনে পড়ছে৷
পত্রিকার সম্পাদকরা উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং পার পেয়ে গেলেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন৷ তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং বিতর্কিত বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিলে আমার আর কোনো ঝামেলা হবে না৷
আমি বললাম, ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে৷ আমি ভুল করিনি৷ উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভার লেখকের না৷ তারপরেও যদি দায়ভার আমার থাকে তাহলে আমি জজ সাহেবরা ঘুষ খান এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না৷ সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি৷ জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি৷ মানুষের সাধারণ ত্রুটি তাদের মধ্যেও থাকবে৷ একজন লেখক হিসেবে আমি তা লিখব৷ আমাদের সংবিধান মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে৷
অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন, আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন৷
আমি বললাম, কী আর করা৷ না হয় একটু বিপদে পড়লাম৷
মামলা শুরু হলো৷ আমি হাইকোর্টে যাই৷ সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা৷ তারা ভয়ে অস্থির, এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন, তিনি বিব্রত৷ মামলায় থাকবেন না৷ কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো৷
সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন তিনি বিব্রত৷ পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল, বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন৷ আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে৷ মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না৷ আর যদি হেরে জেলে যাই ততেও ক্ষতি নেই৷
অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ আমি না হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম৷ আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না৷ একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেওয়া হবে৷ বিছানায় ঘুমাব৷ ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে৷ ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই, চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না৷

হিমুর পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ

কলকাতা থেকে দেশ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়৷ একটা পত্রিকা কতদূর ক্ষমতাধর তা দেশ পত্রিকা না দেখলে আমি জানতাম না৷ বলা হয়ে থাকে যেকোনো অগা মগা বগা লেখককে এই পত্রিকা আসমানে তুলে দিতে পারে৷ মহান লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷ আবার সত্যিকারের মহান কোনো লেখককেও ধরাশায়ী করতে পারে৷ এই পত্রিকায় কারও লেখা ছাপা হওয়ার মানে (বিশেষ করে শারদীয় সংখ্যায়) লেখক হিসেবে কপালে স্থায়ী সিল পড়ে যাওয়া৷ এই সিলের কালি অলেপনীয়, ধুলেও যাবে না৷ কপালে জ্বলজ্বল করতে থাকবে৷
এক সকালে দেশ পত্রিকার এক প্রতিনিধি আমার বাসায় উপস্থিত৷ তার সঙ্গে নানা গল্প হচ্ছে৷ গল্প তিনি করছেন আমি শুনছি৷ আমি ক্লাসে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছি না৷ হাজার হলেও বিদেশি মেহমান৷ এক পর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন, আমরা আপনার একটা উপন্যাস শারদীয় সংখ্যায় ছাপাব৷ তবে দেশে ছাপাব নাকি আনন্দবাজারে ছাপাব, নাকি সানন্দায় ছাপাব তা বলতে পারছি না৷ সাগরময়দা ঠিক করবেন৷
ভদ্রলোক হয়তো ধারণা করেছিলেন তার কথা শুনে আনন্দে আমি এমন লাফ দেব যে সিলিংয়ে মাথা ঠেকে যাবে৷ আমি তা না করে শুকনো গলায় বললাম, হুঁ৷ ভেবে দেখি৷
কী ভাববেন? পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কত বড় সুযোগ৷
আমি ঠাণ্ডা মাথায় বললাম, ভাই আমি সুযোগ সন্ধানী মানুষ না৷ আমি লেখক৷ লেখক কখনো সুযোগের সন্ধান করে না৷ সুযোগ লেখকদের সন্ধান করে৷
তার মানে আপনি লিখবেন না?
আমি বললাম, শুধুমাত্র দেশ পত্রিকা যদি তার শারদীয় সংখ্যায় লেখা ছাপে তাহলেই পাণ্ডুলিপি পাঠাব৷ দেশ পত্রিকা ছাড়া না৷
ভদ্রলোক মোটামুটি হতভম্ব অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, যাই৷ নমস্কার৷
আমি ধরেই নিয়েছিলাম এই বিষয়ে আর কিছু শুনব না৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, পনেরো দিনের মাথায় দেশ পত্রিকার সম্পাদক চিঠি দিয়ে জানালেন তারা আমার একটি উপন্যাস শারদীয় দেশ পত্রিকায় ছাপাতে চান৷ হিমুকে নিয়ে লেখা একটা উপস্যাস পাঠালাম৷ ছাপা হলো৷ পরের বছর আবার চিঠি এবারও তারা একটি উপন্যাস ছাপাবেন৷ পাঠালাম আরেকটা হিমু৷
পর পর ছয় বছর কিংবা সাত বছর আমি শারদীয় দেশ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি৷ বেশির ভাগই হিমুবিষয়ক রচনা৷ পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা আমার সাহিত্য প্রতিভা (?) সম্পর্কে কোনো ধারণা পেয়েছেন কি না জানি না৷ হিমু বিষয়ে ভালোই ধারণা পেয়েছেন৷ তার প্রমাণও পেলাম৷
কলকাতায় গিয়েছি কোনো এক বইমেলায়৷ সে দেশে চেহারা দেখে আমাকে কেউ চিনবে না, কাজেই লেখকসুলভ নকল গাম্ভীর্য নিয়ে হাঁটাহাঁটি করার প্রয়োজন নেই৷ আমি মনের সুখে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একজন আমার পা ছুঁয়ে বলল, দাদা আমি হিমু৷
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ধুতি পরা হিমু দেখছি৷ পাঞ্জাবি হলুদ রঙের৷ পায়ে জুতা নেই – খালি পা৷ লক্ষণ বিচারে হিমু তো বটেই৷
আপনি কত দিন ধরে হিমু?
দুই বছরের উপর হয়েছে দাদা৷
আমি বললাম, পাঞ্জাবির কি পকেট আছে?
পকেট নেই৷
টাকা-পয়সা রাখেন কোথায়?
ভদ্রলোক পাঞ্জাবি উঠিয়ে দেখালেন, কেমারের কালো ঘুনসির সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগ লাগানো – টাকা-পয়সা সেখানেই থাকে৷
দাদা, আমি দুজনের ভক্ত৷ আপনার এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের৷ আপনাদের দুজনের ছবি ঠাকুরঘরে আছে৷
আমি চমৎকৃত৷ সাত বছর দেশ পত্রিকায় লেখালেখির কারণে যদি কারও ঠাকুরঘরে ঢুকে যেতে পারি সেটা কম কী? গলায় সুর থাকলে গাইতাম অকত অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি৷
বিদেশে বেশ কিছু হিমুর দেখা পেয়েছি৷ বিদেশের হিমুরা কঠিন প্রকতির৷ একশ পার্সেন্ট খাঁটি ভেজালবিহীন হিমু৷ জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের হিমুর কথা বলি৷ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা৷ বরফ পড়বে পড়বে করছে, এখনো পড়া শুরু করেনি৷ এই ঠাণ্ডায় খালি পায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে একজন উপস্থিত৷ গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলল, স্যার আমি হিমু৷
কতদিন ধরে?
তিন বছরের বেশি হয়েছে৷ দেশেও হিমু ছিলাম৷
ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে যে হিমু একটা ধর্ম৷ সে ধর্ম পালন করছে৷ এর বেশি কিছু না৷ আমি হিমু ধর্ম প্রচারক৷
গত বইমেলায় এক কাণ্ড ঘটল৷ মধ্যবয়স্ক একজন ভিড় ঠেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, স্যার, আমি ঠিক করেছি মার্চের তিন তারিখ থেকে হিমু হব৷ হিমু হওয়ার নিয়মকানুন কী?
আমি বললাম, মার্চের তিন তারিখ থেকে কেন?
আমার জন্মদিন মার্চের তিন৷ এখন স্যার নিয়মকানুন বলেন৷
আমি নিয়মকানুন কী বলব? ভদলোকের দিকে তাকিয়ে আছি৷ কী বলব ভেবে পাচ্ছি না৷ আমাকে উদ্ধারের জন্য অন্যপ্রকাশের কমল এগিয়ে এল৷ সে গম্ভীর গলায় বলল, নিয়মকানুন সব বইয়ে দেওয়া আছে৷ বই পড়ে জেনে নিন৷ হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হাঁটবেন৷ এইটাই প্রাথমিক বিষয়৷
প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা দেখতে জঙ্গলে যেতে হবে?
গেলে ভালো হয়, তবে দু-একটা মিস হলেও ক্ষতি হবে না৷


বসন্ত বিলাপ

তখন চিটগং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাসটিচার বড়ুয়া স্যার আমাদের বাংলা পড়ান। স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেন, ‘রচনা লেখো “আমার প্রিয় ঋতু”।’ এই বলেই চেয়ারে পা তুলে তিনি ঘুমের প্রস্তুতি নিলেন। আমাদের সময়ে ক্লাসওয়ার্ক দিয়ে শিক্ষকদের ঘুমানো এবং ঝিমানো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এটাকে কেউ দোষের ধরত না। ছাত্ররা তো ক্লাসওয়ার্ক করছেই।
খাতা খুলে বসে আছি, আমার প্রিয় ঋতু কী বুঝতে পারছি না। শীত হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে? শীতের সময় আমরা নানাবাড়ি মোহনগঞ্জে যাই। তখন লেপ নামানো হয়। লেপের ভেতর হুটোপুটি। রাতের উঠানে আগুন জ্বেলে চারদিকে গোল হয়ে বসে ভূতের গল্পের আসর। দিনের বেলা ডোবা সেঁচে মাছ ধরা।
প্রিয় ঋতু ‘শীত’ নিয়ে রচনা লেখা শেষ হলো। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, এক্ষনি ঘণ্টা পড়বে। এ অবস্থায় কারোর রচনাই স্যারের পড়ার সময় নেই। আমরা আনন্দিত। হঠাৎ স্যার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখি কী লিখেছিস?’
আমি ভয়ে ভয়ে খাতা দিলাম। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, ‘প্রিয় ঋতু হবে ঋতুরাজ বসন্ত। তুই লিখেছিস শীত। গাধা, কানে ধর।’
আমি কানে ধরতেই ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় রচনা ছিল ‘তোমার প্রিয় ঋতু’। এইবার আর ভুল হলো না, লিখলাম ঋতুরাজ বসন্ত। রচনার ফাঁকে ফাঁকে কোটেশন ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কোটেশন দেওয়া মানেই ছাঁকা নম্বর।
ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে লেখা কারও কোনো কবিতা মনে না পড়ায় নিজেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলাম। লিখলাম—ঋতুরাজ বসন্তের রূপে মুগ্ধ হইয়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘কত অপূর্ব পুষ্পরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটিয়াছে।’
বালক বয়সে কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তবিষয়ক একটি উদ্ধৃতি (আমার অতি প্রিয়) এখন দিচ্ছি—
‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।’
তিনটি মাত্র লাইনে বসন্ত উপস্থিত। বাঁশি বাজার শব্দও কানে আসা শুরু হয়েছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু কি বসন্ত? তাঁর বসন্তবিলাস দেখে আমি অবাকই হই। এই ব্যাকুলতার কারণ কী? বঙ্গদেশে শীত প্রায় নেই বলেই বসন্তও নেই। আমাদের অল্প কিছু পাতাঝরা বৃক্ষ, পত্রহীন গাছে বসন্তকালে নতুন পাতা আসার ব্যাপারটা সে জন্যই অনুপস্থিত বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন শালবনের ভেতর। শালবনে বসন্তকালে নতুন পাতা আসে—এই দৃশ্য অবশ্যই সুন্দর। তখন কিন্তু পুরোনো পাতা ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য অতি বিরক্তিকর।
এমন কি হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বসন্তবিলাসের পরোক্ষ কারণ পশ্চিমের দেশ? যৌবনে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের দেশে কাটিয়েছেন। তিনি দেখেছেন ভয়ংকর শীতের পর আনন্দময়ী বসন্তের আগমনের সর্বজনীন উচ্ছ্বাস। এই থিওরি বাতিল। রবীন্দ্রসাহিত্য পশ্চিমের প্রভাবমুক্ত। অবশ্যি সমালোচকেরা বলেন, ছোটগল্প লেখার প্রেরণা তিনি পেয়েছেন পশ্চিমা ছোটগল্প পড়ে। তাঁর প্রিয় ছোটগল্পকার এডগার এলেন পো।
সমালোচকেরা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে কোনো লেখকের ওপর অন্যের প্রভাব প্রমাণ করতে পারলে বিমলানন্দ উপভোগ করেন। আমি সমালোচক নই বলেই কারও লেখার ওপরই অন্যের প্রভাব পাই না। আর রবীন্দ্রনাথ তো সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর কত কবিতায় বৃষ্টির বন্দনা আছে। তিনি অসংখ্যবার পশ্চিম দেশের অপূর্ব তুষারপাত দেখেও এই নিয়ে কাব্য রচনা করেননি।
অন্যদিকে আমাদের জীবনানন্দ দাশের পশ্চিমা সাহিত্যের মুগ্ধতা চলে এসেছে তাঁর কাব্যে। তিনি হয়ে গেছেন হেমন্তের কবি। তাঁর হেমন্ত বঙ্গদেশের হেমন্তও না, পশ্চিমা হেমন্ত। ফুল ও পাখির বসন্ত জীবনানন্দকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি।
বসন্ত এসেছে—এই খবর আমি পাই নুহাশপল্লীতে। খবরটা আমাকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। নুহাশপল্লীতে তাঁর অতিপ্রিয় ফুল নীলমণিলতা ফোটে বসন্তকালে। নীলমণিলতা নাম রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। বোটানিক্যাল নাম Patraea volobilis. নুহাশপল্লীতে বাগানবিলাস বসন্তেই হেসে ওঠে। বাগানবিলাস রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। অন্য নাম Bougain Villea. রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা মাধুরীর নামে একটি লতানো গাছের নাম রেখেছেন মাধুরীলতা। এই গাছে ফুল বর্ষাকালে আসে কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে নুহাশপল্লীতে বসন্তকালে মাধুরীলতা ফুলে ফুলে ভরে যেতে দেখেছি। মাধুরীলতার ইংরেজি নাম Quisquallis Indica.
বসন্ত মানেই পাখির গান (‘এত পাখি গায়’), মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো করে ডাকে বউ কথা কও পাখি। এক্ষুনি বউ কথা না বললে সে মারা যাবে অবস্থা। এ কারণেই ‘বউ কথা কও’ পাখির আরেক নাম ব্রেইন ফিভার বার্ড। নজরুলের গানে এই পাখি বারবার এসেছে। বউ কথা কও নামে না, পাপিয়া নামে। বসন্তকালেই শিস দিতে শুরু করে কুটুম পাখি। বনফুল বলেন, ‘খোকা হোক পাখি।’ শ্যামা পাখির গান গাওয়ার সময়ও বসন্তকাল। কোকিল ও দোয়েলের কথা তো বলাই হলো না। এরাও বসন্তের পাখি। (যেসব পাঠক বসন্তের পাখি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে চান, তাঁরা পক্ষীবিশারদ সাদত সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ক্লাব। বসন্তকালে তিনি পাখির গান শোনার জন্য ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘোরেন।)
নুহাশপল্লীতে বসন্তের দিন হলো পাখিদের জলসার দিন। কাঠঠোকরা পাখি যে ঠকঠক শব্দের বাইরে গানও করতে পারে, তা আমি নুহাশপল্লীতে এক বসন্তে প্রথম শুনি। এই পাখি দেখতে যেমন সুন্দর, তার গানের গলাও অদ্ভুত। কাক বসন্তকালে চুপ করে যায়। কা কা কম করে। মনে হয় অন্য পাখিদের বিশেষ করে তার চিরশত্রু কোকিলের হইচইয়ে বিরক্ত হয়ে চুপ করে যায়। বসন্তে কাকের নীরবতার তথ্যটা মজার না?
রবীন্দ্রনাথকে যদি তাঁর প্রিয় ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে বলা হতো, তিনি কি বসন্ত নিয়ে লিখতেন? বসন্ত নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে এ রকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গদেশের প্রতিটি ঋতুর প্রতিই ছিল তাঁর সীমাহীন উচ্ছ্বাস। যিনি লেখেন, ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’, তাঁর প্রিয় ঋতু তো বর্ষা। বর্ষার বর্ণনায় তিনি সেই সব পাখির নাম নিয়েছেন, যারা জলচর এবং শুধু বর্ষাতেই গান করে (ডাহুক, মাছরাঙা, সারস, বকপক্ষী)। তাঁর তীক্ষ পর্যবেক্ষণের বাইরে যাওয়ার উপায় এ দেশের প্রকৃতির ছিল না, আর ছিল না বলেই তিনি লিখতে পেরেছেন, “ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।”
পাদটীকা
এক চৈত্র মাসে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। রোদের তাপে প্রকৃতি ঝলসে যাচ্ছে। মাটি ফেটে চৌচির, আকাশ পিঙ্গল। হঠাৎ দেখি একটা শিমুলগাছ। গাঢ় লাল রঙের ফুল এমনভাবে ফুটেছে যে মনে হয় রোদের তাপে গাছে আগুন লেগে গেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে শুনি, পটকা ফোটার মতো শব্দ হচ্ছে। শিমুল ফুলগুলোর মতো শব্দ করে ফাটে এবং বীজ থেকে বের হয়ে ছোট্ট মেঘের মতো তুলা বাতাসে উড়তে থাকে। এই দৃশ্য প্রথম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। বসন্ত! তোমাকে অভিবাদন।


হিমুর বিয়ে

আমাদের দখিন হাওয়ার ছাদে অনুষ্ঠান হচ্ছে৷ আমার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নিষাদ হুমায়ূনের নামকরণ অনুষ্ঠান৷ হৈচৈ হচ্ছে, গান-বাজনা হচ্ছে৷ হঠাৎ আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার৷ তিনি ঢাকায় এসেছেন এটা জানি৷ কোথায় উঠেছেন জানতাম না বলেই নিমন্ত্রণ করা হয়নি৷ অনেকদিন পর তাকে দেখে ভালো লাগল৷ আমি তার হাত ধরতেই তিনি ধমকের গলায় বললেন, আপনি নাকি হিমুকে বিয়ে দিয়েছেন৷ এটা তো আপনি করতে পারেন না৷ হিমু কেন বিয়ে করবে?
আমি হিমুর বিয়ে দেইনি৷ একটা বই লিখেছি – আজ হিমুর বিয়ে৷ বইটিতে হিমু বিয়ে করে ফেলে জাতীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ বইটির প্রকাশক অন্যপ্রকাশ৷ প্রায় নিয়মিতই তারা বইমেলা উপলক্ষে হিমু বিষয়ক একটা বই পায়৷ বইটির প্রকাশনা উপলক্ষে নানা আয়োজন করে৷ এইবার বিয়ের আয়োজন করে ফেলল৷ একজন পাগড়ি মাথায় বর সাজল, আরেকটি মেয়ে সাজল বউ৷ বর-কনে অন্যপ্রকাশের স্টলে বসে রইল৷ দর্শকদের আগ্রহ এবং কৌতূহল তুঙ্গ স্পর্শ করল৷ চারদিকে দারুণ উত্তেজনা৷ বইমেলায় এমন মজার দৃশ্য আগে হয়নি৷ দু-একজন অবশ্য গম্ভীর গলায় বললেন, বইমেলার শুচিতা নষ্ট হচ্ছে৷ মহান একুশের ঐতিহ্য ভুলুন্ঠিত হচ্ছে ইত্যাদি৷
হিমুর বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না৷ টেলিভিশনে দেখেছি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে, মেলা মানেই আনন্দ৷ মেলার পবিত্রতা রক্ষার জন্য সবাই অজু করে মেলায় আসবেন এবং ফিসফিস করে কথা বলবেন তা কেন হবে? একজন প্রকাশক যদি বুক প্রমোশনের জন্য কিছু করেন তাতেই বা দোষ কোথায়?
ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় দেখেছি, রান্নার বই প্রকাশনা উপলক্ষে রান্নার বিপুল আয়োজন৷ বইয়ের রেসিপি দেখে রান্না হচ্ছে৷ সবাই মহানন্দে খাচ্ছে৷ একদিকে নাচের জলসা হচ্ছে৷ একদল ছেলেমেয়ে উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে৷ বইমেলার ভেতরই বিয়ারের দোকান খোলা৷ প্রচুর বিয়ার খাওয়া হচ্ছে৷
থাক এসব কথা, বিবাহ অনুষ্ঠানে ফিরে যাই৷ হিমু যে হয়েছে সে মৈনাক পর্বতের কাছাকাছি৷ কনে লাক্স সুন্দরী৷ যথেষ্টই রূপবতী৷ একদল হিমু গেল রেগে৷ তারা মৈনাক পর্বতকে হিমু মানতে রাজি না৷ পাল্টা মিছিল শুরু হলো – হিমুর বিয়ে, মানি না মানি না৷
অনেকদিন আগে বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা হেরে গিয়েছিল৷ আমি তখন ময়মনসিংহে অয়োময় নাটকের শুটিংয়ে ব্যস্ত৷ আর্জেন্টিনার পরাজয়ে বিশাল মিছিল বের হলো৷ স্লোগান – আর্জেন্টিনার পরাজয়, মানি না মানি না৷
তারা জানে মানি না মানি না বলে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও কিছু হবে না৷ তারপরেও স্লোগান দিতে হবে৷ জাতিগতভাবে আমরা স্লোগান দিতে ভালোবাসি৷ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধ করার জন্য স্লোগান দিয়েছিল৷ হিমুর বিয়ে বন্ধ করার জন্যও স্লোগান৷
বেচারা হিমু কি কোনোদিনই বিয়ে করতে পারবে না? তার সুখী সুন্দর সংসার হবে না? কোনো শিশু হিমুকে বাবা বলে ডাকবে না? এত নিষ্ঠুর কেন আমরা?


বালক হিমু

পাঁচ-ছয় বছর আগে আমি অতি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ একা একা থাকি দখিন হাওয়ার এক ফ্ল্যাটে৷ নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন৷ মাঝে মধ্যে নুহাশ আসে৷ হোটেল থেকে খাবার এনে দুজন মিলে খাই৷ সে কিছুক্ষণ থাকে৷ দুজন নানা বিষয়ে গল্প করি৷ একদিন সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত৷ আমি বললাম, বাবা পাঞ্জাবিটা সুন্দর তো!
সে খুশি খুশি গলায় বলল, মেজপা (শীলা) নিজের হাতে বানিয়েছে৷
আমি বললাম, ভালো বানিয়েছে৷
নুহাশ বলল, বাবা এটা হিমু পাঞ্জাবি৷ আমি হিমু হয়েছি৷
আমি হিমুর পিঠে হাত রাখলাম৷ তাকিয়ে থাকলাম জানালার দিকে৷ কারণ চোখে পানি এসে যাচ্ছে৷ আমি চাচ্ছি না বালক হিমু পিতার চোখের পানি দেখুক৷
দিন পনেরো আগের কথা৷ লেখালেখি করছি৷ হঠাৎ ধুপ করে আমার কোলে কী যেন পড়ল৷ তাকিয়ে দেখি, সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নিষাদ হুমায়ূন৷ বয়স দুই মাস৷ তার মা তাকে সাজিয়ে এনে আমার কোলে ছেড়ে দিয়েছে৷ শাওন বলল, ছেলেকে দেখে কিছু কি বোঝা যাচ্ছে?
আমি বললাম, না৷
ভালো করে তাকিয়ে দেখ৷
আমি ভালো করে দেখলাম, কপালে কাজলের ফোঁটা ছাড়া আলাদা কিছু পেলাম না৷
শাওন বলল, সে যে হিমু হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না? হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা৷
আমি বললাম, আরে তাই তো!
দুই মাসের শিশু হিমু মহানন্দে হাত-পা ছুড়ছে৷ তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, রাস্তায় ছেড়ে দিলেই সে হাঁটতে শুরু করবে৷ একবারও পেছন ফিরে তাকাবে না৷ হিমুরা কখনো পেছনে তাকায় না৷ হিমু আইনে পেছনে ফিরে তাকানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তারা তাকিয়ে থাকবে ভবিষ্যতের দিকে৷


হিমু সড়ক

হিমুদের প্রধান কর্মকাণ্ড রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা৷ কাজেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই তাদের নামে একটা রাস্তার নাম হতে পারে৷ হিমু সড়ক কিংবা হিমু এভিনিউ৷ সেই সম্ভাবনা কীভাবে তৈরি হলো তার গল্প বলি৷
আমার মাথায় একবার ভূত চাপল অতি আধুনিক রেসিডেন্সিয়াল স্কুল করার৷ স্কুলটা হবে কুতুবপুরে আমার গ্রামের বাড়িতে৷ আদর্শ স্কুল – যা হবে এ দেশের রোল মডেল৷ আমি বেলাল বেগ নামের এক উদ্যোগী এবং স্বপ্নস্রষ্টা মানুষকে যাবতীয় দায়িত্ব দিলাম৷ স্কুলের জন্য জমি কিনতে শুরু করলাম৷
বেলাল বেগ ঢাকা-কুতুবপুর ছোটাছুটি করতে লাগলেন৷ মেহের আফরোজ শাওন স্কুলের ডিজাইন করতে বসল৷ আমাদের সবার মধ্যে বিপুল উৎসাহ৷ এর মধ্যে বেলাল বেগ আমাকে নিয়ে গেলেন এলজিইডি অফিসে৷ সেই অফিস প্রধান কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীও একজন কর্মযোগী মানুষ৷ তাকে বলেকয়ে স্কুলের রাস্তাটা পাকা করানো যায় কি না৷
কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী সাহেব আমাদের বসিয়ে রেখে বেশ কিছু মিটিং সারলেন৷ বসে থাকতে থাকতে আমি নিজে ক্লান্ত এবং কিছু পরিমাণে বিরক্ত৷ যতবার চলে আসতে চাই বেলাল বেগ আমার হাত চেপে ধরেন৷ নিচু গলায় বলেন, আরেকটু অপেক্ষা করুন৷ আমাদের কন্যাদায়৷
এক সময় অতি ক্লান্ত মুখে সিদ্দিকী সাহেব এলেন৷ বেলাল বেগ নানা যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাচ্ছেন স্কুলের জন্য পাঁচ কিলোমিটার পাকা রাস্তা যে কত জরুরি৷ সিদ্দিকী সাহেব খুব যে মন দিয়ে তার কথা শুনছেন এরকম মনে হলো না৷ এক সময় তিনি বেলাল বেগের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হিমু ব্যাপারটা কী বলুন তো?
আমি গেলাম হকচকিয়ে৷ সিদ্দিকী সাহেব বললেন, আমার বড় ছেলেটা কিছুদিন হলো হিমু হয়েছে৷ হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে৷
আমি হেসে ফেললাম৷ হিমু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলাম৷ সিদ্দিকী সাহেব বললেন, আপনারা খাবার না খেয়ে যেতে পারবেন না৷ বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে আমার জন্য খাবার আসে আসুন তিনজন মিলে খাব৷ হয় যদি সুজন তেঁতুল পাতায় নয়জন৷
খাবার টেবিলে সিদ্দিকী সাহেব বললেন, এক মাসের মধ্যে যদি রাস্তাটা পাকা করে দেই তাহলে কি চলবে?
আমি হতভম্ব৷ এক মাসে রাস্তা৷ এও কি সম্ভব? ভদ্রলোক সম্ভব করলেন৷ এক মাসের আগেই রাস্তা পাকা হয়ে গেল৷ আমি ঠিক করলাম, রাস্তার নাম দেব হিমু সড়ক৷ কারণ রাস্তা পাকা করার পেছনে হিমুর সামান্য হলেও ভূমিকা আছে৷
হিমু সড়ক নাম রাখা হলো না৷ অঞ্চলের লোকজন মিটিং করে রাস্তার নাম রাখল ফয়জুর রহমান আহমেদ সড়ক৷ ফয়জুর রহমান আহমেদ আমার বাবা৷ সেই অর্থে রাস্তা হলো হিমুর দাদাজানের নামে৷ এইটাই বা খারাপ কী?


No comments:

Post a Comment